বাংলা - Bangla

প্রবন্ধ লিখি

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - বাংলা - Bangla - সাহিত্য পড়ি সাহিত্য লিখি | NCTB BOOK

ইতোমধ্যে প্রবন্ধ সম্পর্কে তোমরা কিছু ধারণা পেয়েছ। সেই ধারণার ভিত্তিতে কোনো বিষয় ঠিক করে তার উপরে একটি প্রবন্ধ রচনা করো। তোমার প্রবন্ধের শিরোনাম হতে পারে- (ক) যানবাহন, (খ) একটি দুর্যোগময় রাত, (গ) গ্রামের খেলাধুলা, (ঘ) ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, (ঙ) আমার শখ ইত্যাদি।

লেখা হয়ে গেলে তোমার প্রবন্ধ থেকে নিচের বৈশিষ্ট্যগুলো শনাক্ত করো-

  • বিষয়টি ব্যক্তিজীবন বা পারিপার্শ্বিক জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত কি না?
  • একাধিক অনুচ্ছেদে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে কি না?
  • রচনাটিতে কী কী তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে?
  • রচনাটি বিবরণমূলক না বিশ্লেষণমূলক?
  • এখানে তোমার নিজের মত তুলে ধরতে পেরেছ কি না?
  • রচনাটিতে কোনো ভূমিকা ও উপসংহার আছে কি না?
  • রচনাটির মধ্যে কোনো অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা রয়ে গেল কি না?

 

প্রবন্ধ কী

 

 

প্রবন্ধ হলো গদ্যভাষায় রচিত এক ধরনের সুবিন্যস্ত রচনা। প্রবন্ধের মধ্যে তথ্য থাকে, তথ্যের বিবরণ থাকে এবং তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। প্রবন্ধের বিভিন্ন অংশ বা ভাগ থাকে। প্রথম অংশ ভূমিকা; এতে মূল আলোচনার ইঙ্গিত থাকে। এরপর একাধিক অনুচ্ছেদে উপাত্ত ও তথ্যের বিবরণ এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাবন্ধিক নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন। প্রবন্ধের সবশেষ অংশ উপসংহার; এতে প্রাবন্ধিকের সমাপ্তিসূচক মন্তব্য থাকে। প্রবন্ধ চিন্তাশীল রচনা বলে এতে আবেগের চেয়ে যুক্তির প্রাধান্য বেশি।

 

ধরন অনুযায়ী প্রবন্ধ কয়েক রকম হতে পারে; যেমন-বিবরণমূলক, বিশ্লেষণমূলক, কল্পনামূলক ইত্যাদি। বিষয়ের দিক থেকেও প্রবন্ধ নানা রকম হয়ে থাকে; যেমন- সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ, বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ, সমাজ বিষয়ক প্রবন্ধ ইত্যাদি।

 

প্রবন্ধের ভাষা হতে হয় সরল ও স্পষ্ট। লেখার সময়ে বাক্যগুলো এমন হতে হয় যাতে একটি বাক্য পরের বাক্যের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে। এমনকি, একটি অনুচ্ছেদ থেকে আরেকটি অনুচ্ছেদে যাওয়ার সময়েও সেই সম্পর্ক রক্ষা করতে হয়।

 

প্রবন্ধে লেখকের নিজের একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। অভিজ্ঞতা ও পঠনপাঠন এই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে।

 

প্রবন্ধ পড়ি

 

নিচের লেখাটি মোতাহের হোসেন চৌধুরীর (১৯০৩-১৯৫৬) একটি প্রবন্ধ। তিনি বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক। তাঁর একটি বিখ্যাত প্রবন্ধের বইয়ের নাম 'সংস্কৃতি কথা'। নিচের প্রবন্ধটি লেখকের 'সংস্কৃতি-কথা' বই থেকে নেওয়া হয়েছে।

 

লাইব্রেরি

মোতাহের হোসেন চৌধুরী

 

 

 

পুস্তকের শ্রেণিবদ্ধ সংগ্রহকে লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার বলা হয়। সকল প্রকার জ্ঞানকে একত্র করে স্থায়িত্ব দানের অভিপ্রায় থেকে লাইব্রেরির সৃষ্টি। এক ব্যক্তির পক্ষে সর্ববিদ্যাবিশারদ হওয়া অসম্ভব। বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করে। আবার যে ব্যক্তি যে বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করে, তার সবটুকু জ্ঞান মস্তিষ্কে ধারণ করাও তার পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই প্রয়োজন এমন কোনো উপায় উদ্ভাবনের, যার দৌলতে দরকার অনুযায়ী সমস্ত বিষয়ে একটা মোটামুটি জ্ঞান লাভ করা যায়। ফলে লাইব্রেরির সৃষ্টি।

 

লাইব্রেরি তিন প্রকার - ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সাধারণ।

ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ব্যক্তিমনের খেয়ালমতো গড়ে ওঠে তা হয়ে থাকে ব্যক্তির মনের প্রতিবিম্ব। ব্যক্তি যে ধরনের রচনা ভালোবাসে তার প্রাচুর্য, আর যে ধরনের রচনা পছন্দ করে না তার অনুপস্থিতি হয়ে থাকে ব্যক্তিগত লাইব্রেরির বৈশিষ্ট্য। এখানে ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারী সম্রাট, খেয়ালমতো গড়ে তোলে তার কল্পনার তাজমহল। কাব্যপ্রেমিক হলে কাব্যগ্রন্থ দিয়ে, কথাসাহিত্য-প্রেমিক হলে কথাসাহিত্য দিয়ে, ইতিহাসপ্রিয় হলে ঐতিহাসিক গ্রন্থ দিয়ে সে সাজিয়ে তোলে তার টেবিল, আলমারির শেলফ-সব কিছু। কারো বাধা দেওয়ার অধিকার নেই, আপত্তি করবার দাবি নেই, উপদেশ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। এখানে সে স্বাধীন, স্বতন্ত্র।

ব্যক্তিগত লাইব্রেরি যেমন ব্যক্তির ইচ্ছার প্রতিবিম্ব, পারিবারিক লাইব্রেরি তেমনি পরিবারের অন্তর্গত ব্যক্তিসমূহের সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রতিচ্ছায়া। এখানে যেমন একের রুচির ওপর বহুর অত্যাচার অশোভন, তেমনি বহুর রুচির উপর একের জবরদস্তি অন্যায়। দশ জনের রুচির দিকে নজর রেখেই পারিবারিক লাইব্রেরি সাজাতে হয়।

ব্যক্তিগত ও পারিবারিক লাইব্রেরি ব্যক্তি বা পরিবারের মর্জিমাফিক গড়ে ওঠে। সাধারণের হুকুম চালাবার মতো সেখানে কিছুই নেই। লাইব্রেরি-সম্পন্ন ব্যক্তির চালচলনে এমন একটা শ্রী ফুটে উঠতে বাধ্য, যা অন্যত্র প্রত্যক্ষ করা দুষ্কর। সত্যিকার বৈদগ্ধ্য বা চিৎপ্রকর্ষের অধিকারী হতে হলে লাইব্রেরির সঙ্গে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি করা অবশ্য প্রয়োজনীয়। তাছাড়া, লাইব্রেরি বা শ্রেণিবদ্ধ পুস্তক-সংগ্রহ গৃহসজ্জার কাজেও লাগে। আর এই ধরনের গৃহসজ্জায় লাভ এই যে, বাইরের পারিপাট্যের সঙ্গে তা মানসিক সৌন্দর্যেরও পরিচয় দেয়। লাইব্রেরি সৃজনে তৎপর হয়ে ধনী ব্যক্তিরা পুস্তক কেনার নেশা সৃষ্টি করলে দেশের পক্ষে লাভ হবে এই যে-অনবরত বাঁধানো পুস্তকগুলো হাতড়াতে হাতড়াতে তাদের চামড়ার তলে যে একটি মন সুপ্ত রয়েছে, সে সম্বন্ধে তাঁরা সচেতন হয়ে উঠবেন। লাইব্রেরি সৃজনের দরুন তাঁরা নিজেরা ততটা লাভবান না হলেও তাঁদের পুত্রকন্যাদের যথেষ্ট উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা। হয়তো এই লাইব্রেরি থাকার দরুনই পরিণত বয়সে তাঁরা সুসাহিত্যিক বা সাহিত্য-সমঝদার হয়ে উঠবেন। এ আশা শুধু ভিত্তিহীন কল্পনা নয়, বড়ো বড়ো সাহিত্যিক বা কবিদের জীবনী আলোচনা করলে দেখা যায়, বাল্যে তাঁরা পিতার অথবা পারিবারিক লাইব্রেরি থেকে সাহিত্যসাধনার প্রেরণা লাভ করেছেন।

সাধারণ পাঠাগার আধুনিক জিনিস। কারণ, ঐতিহাসিকরা কী বলবেন জানি না, যে জ্ঞানার্জন স্পৃহা থেকে পাঠাগারের জন্ম, ব্যাপকভাবে তার জাগরণ-স্পৃহা সহজে মেটানো সম্ভব নয়। জ্ঞানের বাহন পুস্তক, আর পুস্তক কিনে পড়া যে দুঃসাধ্য ব্যাপার, তা ধারণা করা সহজ। পুস্তকের ব্যাপারেও সমবায়নীতির প্রবর্তন আবশ্যক। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও দশে মিলে কাজ না করলে সার্থকতা লাভ করা অসম্ভব। এ ব্যাপারে দশের মিলিত ফলস্বরূপ যা পাওয়া যায়, তাকেই সাধারণ লাইব্রেরি বলা হয়। অবশ্য সাধারণ লাইব্রেরি ব্যক্তির দানও হতে পারে। তবে ব্যক্তিগত প্রভাবের চাইতে সাধারণের প্রভাবই সেখানে বলবত্তর হতে বাধ্য। যদি না হয়, তবে সাধারণ পাঠাগার না বলে ব্যক্তিগত পাঠাগার বলাই ভালো।

সাধারণ লাইব্রেরির পুস্তক শ্রেণিবদ্ধ করতে যথেষ্ট সতর্কতার পরিচয় দিতে হলেও পুস্তক নির্বাচনে বিশেষ সাবধানতার পরিচয় দিতে হয় বলে মনে হয় না। সাধারণ লাইব্রেরির পুস্তক সংগ্রহ বিষয়ে আরেকটি কথা বলা দরকার। পুস্তক নির্বাচনকালে জাতীয় বৈশিষ্ট্য বা জাতীয় সংকীর্ণতার পরিচয় যত কম দেওয়া হয়, ততই ভালো। কারণ, যতদূর মনে হয়, পাঠাগার জাতীয় বৈশিষ্ট্যের রক্ষক নয়, ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের বিকাশক। আর ভালো পুস্তক লেখক যখন কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের লোক নন, সমস্ত সম্প্রদায়ের আত্মীয়, তখন পুস্তক নির্বাচনকালে সংকীর্ণ মনোভাব-সম্পন্ন না হওয়াই ভালো।

জাতির জীবনধারা গঙ্গা-যমুনার মতো দুই ধারায় প্রবাহিত। এক ধারার নাম আত্মরক্ষা বা স্বার্থ প্রসার, আরেক ধারার নাম আত্মপ্রকাশ বা পরার্থ বৃদ্ধি। একদিকে যুদ্ধবিগ্রহ মামলা-ফ্যাসাদ প্রভৃতি কদর্য দিক, অপর দিকে সাহিত্য শিল্প ধর্ম প্রভৃতি কল্যাণপ্রদ দিক। একদিকে শুধু কাজের জন্য কাজ, অপর দিকে আনন্দের জন্য কাজ। একদিকে সংগ্রহ, আরেক দিকে সৃষ্টি। যে জাতি দ্বিতীয় দিকটির প্রতি উদাসীন থেকে শুধু প্রথম দিকটির সাধনা করে, সে জাতি কখনো উঁচু জীবনের অধিকারী হতে পারে না। কোনো প্রকারে টিকে থাকতে পারলেও নব নব বৈভব সৃষ্টি তার দ্বারা সম্ভব হয় না। মানসিক ও আত্মিক জীবনের সাধনা থেকে চরিত্রে যে শ্রী ফুটে ওঠে, তা থেকে তাকে এক রকম বঞ্চিত থাকতেই হয়। জীবনে শ্রী ফোটাতে হলে দ্বিতীয় দিকটির সাধনা আবশ্যক। আর সেজন্য লাইব্রেরি এক অমূল্য অবদান।

 

লাইব্রেরি জাতির সভ্যতা ও উন্নতির মানদণ্ড কারণ, বুদ্ধির জাগরণ-ভিন্ন জাতীয় আন্দোলন হুজুগপ্রিয়তা ও ভাববিলাসিতার নামান্তর, আর পুস্তক অধ্যয়ন ব্যতীত বুদ্ধির জাগরণ অসম্ভব।

 

(সংক্ষেপিত)

 

শব্দের অর্থ

 

অভিপ্রায়: ইচ্ছা। 

বৈদগ্ধ্য: পান্ডিত্য। 

উদ্ভাবন: নতুন কিছু তৈরি করা। 

বৈভব: ঐশ্বর্য কাব্যপ্রেমিক: যে কবিতা ভালোবাসে। ভাববিলাসিতা: কল্পনাবিলাস। 

চিৎপ্রকর্ষ: জ্ঞানচর্চার ফলে মনের উন্নতি। 

মর্জিমাফিক: খেয়াল অনুসারে। 

জবরদস্তি: জুলুম। 

শ্রী: সৌন্দর্য। 

দুষ্কর: সহজে করা যায় না এমন। 

শ্রেণিবদ্ধ: সারিতে সাজানো। 

পরার্থ: পরের উপকার। 

সমঝদার: ভালো বোঝে এমন। 

পারদর্শিতা: পটুতা। 

সমবায়: বহু মানুষের মিলিত উদ্যোগ। 

পারিপাট্য: গোছানো ভাব। 

সম্প্রদায়: গোষ্ঠী। 

প্রতিচ্ছায়া: প্রতিফলন। 

সর্ববিদ্যাবিশারদ: সব বিষয়ে পাণ্ডিত্যের অধিকারী। 

প্রতিবিম্ব: প্রতিচ্ছবি। 

প্রবর্তন: প্রচলন। 

বলবত্তর: অধিক বলশালী। 

বিকাশক: যা বিকাশ ঘটায়। 

সৃজন: সৃষ্টি। 

স্পৃহা: ইচ্ছা; আকাঙ্ক্ষা। 

স্বেচ্ছাচারী: যে অন্যের মতকে তোয়াক্কা করে না।

Content added || updated By

আরও দেখুন...

Promotion